
আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও নিবন্ধন
একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় হতে পারে আবার আঞ্চলিকও হতে পারে। জাতীয় দলগুলিকে নিবন্ধন দিবে নির্বাচন কমিশন এবং তার কার্যক্রম কোন এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। সারা দেশে বা দেশের বাইরে তারা তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারবে। আঞ্চলিক দলগুলো হবে জেলা ভিত্তিক এবং এর নিবন্ধন হবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে। আঞ্চলিক দল ধীরে ধীরে জাতীয় দলে পরিণত হতে পারে। একাধিক জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইলে উক্ত দলকে জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধন ফি দুই ধরণের দলের জন্য দুই প্রকারের হবে, তবে কাজের ক্ষেত্রে দলগুলির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। সব ধরণের নির্বাচনে উভয় প্রকার দল অংশ গ্রহন করতে পারবে। জাতীয় দলের প্রতীক নির্দিষ্ট থাকবে এবং এই প্রতীক অন্য কোন দল ব্যবহার করতে পারবে না। আঞ্চলিক দলের প্রতীকগুলো জেলা পর্যায়ে নির্দিষ্ট থাকবে এবং কোন দলের প্রতীক একই জেলার অন্য কোন দল ব্যবহার করতে পারবে না, তবে অন্য জেলায় অন্য দল ব্যবহার করতে পারবে।
শুধু অফিস, কমিটি ও গঠনতন্ত্র থাকলে একটি দল নিবন্ধন পেতে পারে। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল প্রথা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক। কেননা এতে বড় দলগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য রোধ হবে এবং নেতাদের মধ্যে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বাড়বে। সরকারের দায়িত্ব হবে শুধু দলগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যেন তারা দেশ বা জনস্বার্থ বিরোধী কোন কাজ করতে না পারে। নিবন্ধনের সময় দল প্রধানের ব্যক্তিগত চরিত্র, নীতি নৈতিকতা, সামাজিক অবদান, মেধার স্বীকৃতি ইত্যাদি বিচেনায় নিতে হবে এবং কর প্রদানের সনদ বাধ্যতামূলক করতে হবে। একজন সুনাগরিকের হাতে যদি একটি দল পরিচালিত হয় তবে তার অনুসারীরাও সৎ ও যোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারা যদি সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করেন, তবে রাজনীতির উন্নতির সাথে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন সম্ভব হবে।
ভারতে জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলে প্রায় দুহাজার রাজনৈতিক দল আছে। অন্যান্য অনেক দেশে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল প্রথা প্রচলিত আছে এবং তারা রাজনীতি ও দেশে উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সে তুলনায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অপ্রতুল। ঢাকা শহরে বসে মনে হয় বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো শত শত রাজনৈতিক দল গড়ে ঊঠছে। আসল চিত্র ভিন্ন। গ্রামে গেলে দেখা যায় হাতে গোনা চার-পাঁচটি দল ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কোন রাজনৈতিক দল নেই। কেননা ছোট দলগুলোর পরিমন্ডল খুবই সীমিত। অর্থ ও ভালো পলিসির অভাবে ছোট দলগুলো বড় হতে পারে না। নেতাকে কেন্দ্র করে এসব দলগুলি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিকই থেকে যায়। নিবন্ধন না থাকার কারণে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। তাছাড়া বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা বা নির্বাচন কেন্দ্রীক রাজনীতি করে না। দুএকটি দল যা করে তারাও জোটভূক্ত হয়ে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচন করে। অর্থাৎ বাম ধারার কোন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের রাজনীতি মূলতঃ সামাজিক আন্দোলনের মতো, শুধু সচেতনতা সৃষ্ঠিই যাদের কাজ।
স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থাও কঠিন। একটি অগণতান্ত্রিক কালো আইন দ্বারা ১% ভোটারের স্বাক্ষরের বিধান করে স্বতন্ত্র নির্বাচনের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে পুরান ধাচের রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষ বেঁছে নিতে বাধ্য হয়। রাজনীতিকে কলুষিত করার কারণে তাদের কর্মকান্ডে সবক্ষেত্রে মানুষ সন্তুষ্ট থাকে না। কিন্তু তাদের সামনে বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। জনগণের একটি বৃহৎ অংশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে যা গণতন্ত্রের জন্য একটি অন্তরায়। যারা ভোট দিচ্ছে তারাও এক দলের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে অন্য দলকে সমর্থন দিচ্ছে যা ইচ্ছাকৃত বা ভালো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, বরং আপাততঃ নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য।
এখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্তমানে দলীয় প্রতীকে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রচুর বিকর্ত আছে। আগে শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হতো। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ ইত্যাদি হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখে। ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। স্থানীয়ভাবে গ্রহনযোগ্য, স্বচ্ছল বা প্রভাবশালী অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ গ্রহনের সুযোগ পেত। কিন্তু বর্তমান পদ্ধতিতে সেই সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এখন ইচ্ছা করলেই একজন ব্যক্তি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পারবেন না, তাকে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ দেশ বা সমাজের সেবা করার জন্য রাজনীতির বাইরে স্বতন্ত্র কোন পথ খোলা নেই।
এমতাবস্থায় হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি উন্মুক্ত করে দিতে হবে, না হয় রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়া সহজীকরণ করতে হবে এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল থাকা মন্দ কিছু নয়। একটি দলে একজন ইউনিয়ন মেম্বার বা চেয়ারম্যান থাকতে পারে। সেখানে ভাল নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। যার যেমন সামর্থ সে সেই পর্যায়ে রাজনৈতিক দল চালাবে। জন্ম নিয়েই কোন একটি দলকে সারা দেশে বিস্তার ঘটাতে হবে এমন শর্ত জুড়ে দেয়া অবান্তর।
রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে কোন অপকর্ম বা দুর্নীতি হয় না। দুর্নীতি হয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। যারা ক্ষমতায় আছে বা ছিল, যাদের আর্থিক সক্ষমতা বা চারিদিকে আস্থাভাজন প্রভাবশালী লোকজন আছে তারা দুর্নীতি বা অন্যায় কর্ম করতে উৎসাহিত হয়। যারা ছোট বা নতুন দল করে, তাদের উদ্দেশ্য থাকে সৎকর্ম ও সদাচরণ দিয়ে মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করা এবং নিজের আদর্শ দিয়ে মানুষকে কাছে টানা। নিজেদের ব্যক্তিগত গ্রহনযোগ্যতা ছাড়া অন্যকে দলে ভেড়ানোর কোন উপায় নতুন বা ছোট দলগুলির থাকে না। সে কারণে নতুন বা ছোট দলগুলির নেতারা অপেক্ষাকৃত সৎ থাকে। বড় দলের সদস্যরা কোন কিছু কেয়ার করতে চায় না। কারণ চারিদিকে তাদের রক্ষা করার লোক থাকে। আঞ্চলিক বা ছোট দলগুলিকে রাজনীতি করার অবাধ সুযোগ দিলে রাজনীতি পরিশুদ্ধ হবে।
মোঃ ইয়ারুল ইসলাম