
নেতৃত্বের স্বরূপ
নেতা হবেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। সমাজের আর পাঁচ-দশ জন লোক থেকে তিনি শৌর্যে-বীর্যে-মেধা-মননে আলাদা হবেন। আকর্ষণীয় চরিত্র, সাহস ও মনোবল থাকবে তার। চারিত্রিক দৃঢ়তায় তিনি অন্যদের মুগ্ধ করবেন। অন্যরা একদিকে তার ভক্ত হবেন এবং অন্য দিকে তাকে অনুসরণ করবেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে। তার গ্রহণযোগ্যতার বিচার হবে একেবারে বাল্যকাল থেকে। বাল্যকালে তিনি কেমন ছিলেন, পরিবারের গন্ডি পেরিয়ে তিনি তার মেধা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন কিনা, তার জ্ঞান ও আচার ব্যবহার অন্যদের দৃষ্টি কেড়েছে কিনা।
মানুষ হিসেবে পরিবেশের আবহে একজন ব্যক্তির নৈতিক স্খলন ঘটতেও পারে, তবে অনুতপ্ত হয়ে তিনি নিজেকে শুধরে নিতে পেরেছেন কিনা, সমাজের চারিদিকের এই মানবিক বিপর্যায়গ্রস্থ স্রোতে নিজেকে তিনি সপে দিয়েছেন নাকি বিবেকের চর্চা করেন, তিনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, নাকি সমাজে অবদান রাখার মতো কোন কাজ করেছেন বা করেন এসব দেখে নেতা নির্বাচন করতে হবে।
নেতৃত্ব যদি নিজের দ্বারা অর্জিত হয়, তবে সেই নেতার জন্য জনপ্রতিনিধি হওয়া আবশ্যকীয় নয়। তিনি এমনিতেই নেতা। জনপ্রতিনিধিত্ব একটি সাময়িক ধারণা, এটি নেতৃত্ব নয়, দায়িত্ব, দলের অথবা সরকারের প্রতি। এই দায়িত্ব অর্পিত হতে পারে, যেমন উত্তরাধিকারসূত্রে হঠাৎ পদে বসে যাওয়া; আবার দখলকৃত হতে পারে, যেমন অর্থ বা প্রভাব খাটিয়ে দায়িত্ব লাভ করা। একজন নেতা যদি জনপ্রতিনিধি হন, তবে সে সমাজ এগিয়ে যায়; আর জনপ্রতিনিধি যদি হন নীতিহীন, অত্যাচারী, আত্মকেন্দ্রিক, দূর্নীতিবাজ, তবে সে সমাজে মূল্যবোধের সংকট দেখা যায়, ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় সে সমাজ ব্যবস্থা।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা পেশাগত জীবনে তিনি কতটুকু সততা ও নিষ্ঠার প্রমাণ দিতে পেরেছেন, পারলে কিভাবে পারলেন, তার জীবন দর্শন কী এগুলো জনগণ যদি অনুসরণ করে তবে তিনি নেতা হওয়ার যোগ্য। তাকে প্রমাণ করতে হবে সংগ্রাম করে তিনি জীবনে এগিয়ে গিয়েছেন, কোন রেডিমেড জিনিস নিয়ে তিনি তার অবস্থান তৈরী করেননি। উত্তরাধিকারসূত্রে তার সম্পদ-সম্পত্তি থাকতে পারে, তবে মেধা-মনন, সততা, যোগ্যতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এগুলো নিজেকে অর্জন করে নিতে হয় পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে। এগুলো না পারলে তাকে নেতা বলা যাবে না। জোরপূর্বক ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ টাইপের জনপ্রতিনিধি হওয়া যায়, কিন্তু নেতা আর জনপ্রতিনিধি এক নয়। জনপ্রতিনিধি সমাজের দায়িত্ব পায়, আর নেতা থাকেন জনগণের হৃদয়ে, শ্রদ্ধার আসনে।
নেতৃত্ব বৃহৎ বৃক্ষের মত যার নীচে সবাই আশ্রয় নিতে চায়। দীর্ঘদিনের তৈরী নেতৃত্ব বিষবৃক্ষের ন্যায় সবাইকে ছায়াদান করলেও তার নীচে আশ্রয় গ্রহণকারীরা নিঃশ্বাষের সাথে বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্স্রাইড গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে নিঃশ্বেষ হয়ে যান। এ ধরণের বিষবৃক্ষ প্রত্যেক দেশে থাকে। এই বিষবৃক্ষের নীচে থাকার চেয়ে সূর্যের রৌদ্র অনেক ভাল-এই ভেবে মানুষ বিষবৃক্ষের ছায়া ত্যাগ করেন এবং অন্য আশ্রয় প্রত্যাশা করেন। কিন্তু অন্য আশায় যেখানে মানুষ গ্রহণ করবে, সেটা আস্থার জায়গা হতে হবে। সেটা যেন অন্য এক বিষবৃক্ষ না হয় মানুষ তার নিশ্চয়তা চায়। কেননা প্রবাদ আছে, যেই যায় লংকায় সেই হয় রাবণ, অথবা এই বিড়াল বনে গেলে বন বিড়াল হয়।
অপনেতৃত্বকে আমাদের দেশের জনগণ ঘৃণা করেন, তবে ভাল মানুষরা ভোটে দাড়ালে ভোট পান না- এমন একটা ধারণা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। এর মানে এই নয় যে, আমাদের দেশে ভাল নেতৃত্ব মানুষ চান না। জনগণ ভাল নেতৃত্ব চান তবে যাকে ভোট দেবেন তাকে আগে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি অন্যদের মতো হবেন না। হঠাৎ কেউ নেতা হতে চাইলে জনগণ তাকে মানবেন কেন?
সেজন্যে দরকার সামাজিক রাজনীতি তথা সামাজিক কর্মকান্ড ও পেশাগত উৎকর্ষতা সাধনের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্যরূপে প্রমাণ করা। সামাজিক কর্মকান্ড ও পেশায় সততা, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়ে যদি কোন ব্যক্তি নিজের গ্রহনযোগ্যতা তৈরী করতে সক্ষম হন, তবে তিনি পরবর্তীতে নেতৃত্ব দাবী করতে পারেন। তিনি যদি অন্যদের তূলনায় জ্ঞান, বুদ্ধি, স্বভাব-চরিত্র, নৈতিক মূল্যবোধ, ধৈর্যশক্তি, দূরদর্শিতা, বিচক্ষনতা ইত্যাদি গুণের আধিক্যের প্রমাণ দিতে পারেন, তবে তিনি নেতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
সমাজে পরিচিত হওয়ার বর্তমান সবচেয়ে সহজ উপায় ছবি সম্বলিত পোস্টার দিয়ে বিভিন্ন উপলক্ষে জনগণকে জানান দেয়া। কোন প্রকারে পয়সা করতে পারলেই এ পদ্ধতিতে নেতা! সমাজের সবাই এ সকল হঠাৎ নেতাদের চিনে যাচ্ছেন। তার ব্যক্তিগত চরিত্র কেমন, সে কিভাবে পয়সা করল, তার অতীত জীবন কেমন এসব জানার সুযোগ বা প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে তাৎক্ষনিকভাবে তারা যে পোস্টার ব্যবহার করছে তাতে কাগজের প্রচুর অপচয় হচ্ছে এবং কাগজের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্য অনেক জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই পোস্টার সংষ্কৃতি বন্ধ হওয়া দরকার।
নেতার পরিচয় ঘটবে কৃতিত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে, পোস্টার দিয়ে আত্নপ্রচার কিংবা কোন নির্দয় বা অনৈতিক কাজ করে সাড়া জাগানোর মাধ্যমে নয়। নেতৃত্ব গড়ে উঠতে হবে ধীরে ধীরে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। হঠাৎ যারা নেতা হতে চায় তারা সমাজ ও দেশের জন্যে ক্ষতিকর। তারা দূর্নীতি প্রবণ ও আত্নকেন্দ্রিক হয়। পারিবারিক প্রভাবে, সেনা বাহিনী থেকে অথবা অবৈধ সম্পদ অর্জন করে হঠাৎ নেতারা আবির্ভূত হয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে। এরা সমাজের উৎপাতকারী (Disturbing Element) শ্রেণীর মতো জনগণের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকে। কোন রকমের জনসম্পৃক্ততা ছাড়া হঠাৎ এ শ্রেণীটি জনগণকে শোসন করতে থাকে আর নিজেদের আখের গোছায় জনসেবার নামে।
হঠাৎ নেতাদের কারণে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে না; সৎ, ত্যাগী ও মেধাবীদের মূল্যায়ন হয় না। সন্ত্রাস, দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সবখানে মাথা চাড়া দেয়। এদের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের গভীরতা কম থাকে। কেননা এরা সহজ পথে উঠে আসা শ্রেণী যাদের সামাজিক জীবনের বাস্তবতা, নির্মমতা সম্পর্কে ধারণা কম থাকে। এদের কাছ থেকে ভাল কিছু শেখারও থাকে না এবং দেশ-জাতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভাল পরিকল্পনা বা দিক নির্দেশনাও তাদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। এরা মোসাহেবদের বুদ্ধিতে দেশ চালায়। মোসাহেবরা বুদ্ধি দেয়ার সময় নিজেদের স্বার্থের বিষয়টি সব সময় বিবেচনায় রাখে। ফলে হঠাৎ নেতাদের নেতৃত্বের কারণে দেশের গোষ্ঠিভিত্তিক স্বার্থ হাচিল হয়। সামগ্রিক উন্নয়ন সেখানে সম্ভব হয় না এবং সমাজ ও দেশ পিছিয়ে পড়ে।
সুতরাং হঠাৎ নেতাদের বর্জন করতে হবে। সৎ ও যোগ্য লোকের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। দল দেখে ভোট দেয়া যাবে না। প্রার্থী দেখে ভোট দিতে হবে। তাহলে ভাল লোকরা দেশ ও সমাজের নেতৃত্বে উৎসাহিত হবেন। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, যে জাতি যেমন আল্লাহ তাদের ওপর তেমন নেতৃত্ব চাপিয়ে দেন। কোরআনে আছে, নেতৃত্ব সম্পূর্ণ আল্লাহ’র দান। আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যদি না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। সুতরাং সময় এসেছে নতুন চিন্তার, নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের, নতুন ও সৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির, বিচক্ষণতার সাথে নতুন রাজনীতির এবং রাজনীতিতে ভাল লোকদের এগিয়ে আসার।
সবক্ষেত্রে ভাল লোকদের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তার জন্যে দরকার ভাল মানুষের নেতৃত্বে সংগঠন। সেই সংগঠনের মাধ্যমে ভাল লোকগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের তালিকা করতে হবে এবং তাদেরকে আগামী দিনের নেতৃত্ব নেয়ার জন্যে প্রস্তুত করতে হবে। কেননা বর্তমান ধারার রাজনৈতিক সংষ্কৃতিতে মানুষ অতিষ্ঠ। এই অপরাজনৈতিক সংষ্কৃতি একদিন ভাঙবেই। কেননা অন্ধকারের পরেই আলোকিত ভোর আসে। তখনকার নেতৃত্ব নেয়ার জন্যে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে জোর করে ক্ষমতা নেয়া নৈতিক কাজ নয়। সময় হলে নেতৃত্ব এননিতেই হাতে চলে আসবে। তার জন্যে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করে, জান-মালের ক্ষতি করে নেতৃত্ব নেয়া দেশ-জাতির উপকার নয়, বরং ক্ষতি।
নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায় থেকে। কোন প্রকার অনৈতিক সুবিধা নেয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে প্রত্যেককে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে হবে। তাহলে সেটাই হবে দেশসেবা ও নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে যোগ্যরূপে গড়ে তোলা। অনৈতিক, নিষ্ঠুর বা অগ্রহণযোগ্য কোন কাজের মাধ্যমে সমাজে পরিচিত হলেই তাকে নেতা মানা যাবে না। কেননা দূর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য এবং সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। সুতরাং ভাল লোকের ঐক্য গড়ে ভাল লোকের সংষ্পর্শে থাকতে হবে এবং সংসার চালানোর জন্যে কোন অনৈতিক সুবিধা না নিয়ে শুধু বৈধ পেশার ওপর নির্ভর করতে হবে। এভাবে আদর্শ ব্যক্তি গঠনের মাধ্যমে আদর্শ পরিবার গঠন করতে হবে যা আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি।
মোঃ ইয়ারুল ইসলাম