
ব্যাঙের ছাতার মতো রাজনৈতিক দল কি ক্ষতিকর
রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে কোন অপকর্ম বা দুর্নীতি হয় না। দুর্নীতি হয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। যারা ক্ষমতায় আছে বা ছিল, যাদের আর্থিক সক্ষমতা বা চারিদিকে আস্থাভাজন প্রভাবশালী লোকজন আছে তারা দুর্নীতি বা অন্যায় কর্ম করতে উৎসাহিত হয়। যারা ছোট বা নতুন দল করে, তাদের উদ্দেশ্য থাকে সৎকর্ম ও সদাচরণ দিয়ে মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করা এবং নিজের আদর্শ দিয়ে মানুষকে কাছে টানা। নিজেদের ব্যক্তিগত গ্রহনযোগ্যতা ছাড়া অন্যকে দলে ভেড়ানোর কোন উপায় নতুন বা ছোট দলগুলির থাকে না। সে কারণে নতুন বা ছোট দলগুলির নেতারা অপেক্ষাকৃত সৎ থাকে। বড় দলের সদস্যরা কোন কিছু কেয়ার করতে চায় না। কারণ চারিদিকে তাদের রক্ষা করার লোক থাকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক। কেননা এতে নেতাদের মধ্যে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বাড়বে। সবাই চাইবে ভালো কাজ করে এবং সৎ ও নীতিবান থেকে মানুষকে নিজের দলে আকৃষ্ট করা। এতে স্থানীয় পর্যায়ে সৎ ও যোগ্য মেম্বার, চেয়ারম্যান, মেয়র পাওয়া সম্ভব হবে।
একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় হতে পারে আবার আঞ্চলিকও হতে পারে। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের সকল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো মূলতঃ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলেও জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। সুতরাং থানা, জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে কোন রাজনৈতিক দল থাকা মন্দের কিছু নয়। শত-সহস্র দল হলেও কোন সমস্যা নেই।
প্রতিটি দলকে সরকারের কাছ থেকে কিছু শর্তের আলোকে নিবন্ধন নিতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হবে শুধু দলগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যেন তারা দেশ বা জনস্বার্থ বিরোধী কোন কাজ করতে না পারে। নিবন্ধনের সময় দল প্রধানের ব্যক্তিগত চরিত্র, নীতি নৈতিকতা, সামাজিক অবদান, মেধার স্বীকৃতি ইত্যাদি বিচেনায় নিতে হবে এবং সরকারকে কর প্রদান করার সনদ বাধ্যতামূলক করতে হবে। একজন সুনাগরিকের হাতে যদি একটি দল পরিচালিত হয় তবে তার অনুসারীরাও সৎ ও যোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারা যদি সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করেন, তবে রাজনীতির উন্নতির সাথে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন সম্ভব হবে।
ভারতে জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলে প্রায় দুহাজার রাজনৈতিক দল আছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অপ্রতুল। ঢাকা শহরে বসে মনে হয় বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো শত শত রাজনৈতিক দল গড়ে ঊঠছে। আসল চিত্র ভিন্ন। গ্রামে গেলে দেখা যায় হাতে গোনা চার-পাঁচটি দল ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কোন রাজনৈতিক দল নেই। কেননা ছোট দলগুলোর পরিমন্ডল খুবই সীমিত। অর্থ ও ভালো পলিসির অভাবে ছোট দলগুলো বড় হতে পারে না। নেতাকে কেন্দ্র করে এসব দলগুলি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিকই থেকে যায়। নিবন্ধন না থাকার কারণে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। তাছাড়া বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা বা নির্বাচন কেন্দ্রীক রাজনীতি করে না। দুএকটি দল যা করে তারাও জোটভূক্ত হয়ে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচন করে। অর্থাৎ বাম ধারার কোন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের রাজনীতি মূলতঃ সামাজিক আন্দোলনের মতো, শুধু সচেতনতা সৃষ্ঠিই যাদের কাজ।
স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থাও কঠিন। একটি অগণতান্ত্রিক কালো আইন দ্বারা ১% ভোটারের স্বাক্ষরের বিধান করে স্বতন্ত্র নির্বাচনের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে পুরান ধাচের রাজনৈতিক দলগুলোকে মানুষ বেঁছে নিতে বাধ্য হয়। রাজনীতিকে কলুষিত করার কারণে তাদের কর্মকান্ডে সবক্ষেত্রে মানুষ সন্তুষ্ট থাকে না। কিন্তু তাদের সামনে বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। জনগণের একটি বৃহৎ অংশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে যা গণতন্ত্রের জন্য একটি অন্তরায়। যারা ভোট দিচ্ছে তারাও এক দলের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে অন্য দলকে সমর্থন দিচ্ছে যা ইচ্ছাকৃত বা ভালো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, বরং আপাততঃ নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য।
এখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্তমানে দলীয় প্রতীকে হচ্ছে। সুতরাং এক্ষুণি দরকার প্রচুর রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল থাকা মন্দ কিছু নয়। একটি দলে একজন ইউনিয়ন মেম্বার বা চেয়ারম্যান থাকতে পারে। সেখানে ভাল নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। যার যেমন সামর্থ সে সেই পর্যায়ে রাজনৈতিক দল চালাবে। জন্ম নিয়েই কোন একটি দল সারা দেশে বিস্তার ঘটাবে এমন কোন কথা নেই। কাজের মাধ্যমে একটি দল আঞ্চলিক থেকে জাতীয় দলে পরিণত হতে পারে। তবে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জাতীয় বা আঞ্চলিক কোন ভাগ থাকবে না। সব দল সমান মর্যাদায় নিবন্ধন নিবে। কোন ব্যক্তি যদি কর প্রদানকরী নাগরিক হন এবং তিনি যদি দেশ ও জনস্বার্থ বিরোধী কোন কর্মকান্ডে জড়িত না থাকেন, তবে রাষ্ট্র তাকে দল গঠনের অনুমতি দিতে পারে।
সরকার গঠনে বড় দলগুলোর সাথে ছোট দলগুলো যুক্ত হতে পারে, সেটা নির্বাচিত হওয়ার পরে হতে পারে আবার জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এতে ছোট দলগুলোর গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে। এখানেও ছোট দলগুলো চাইবে বেশী বেশী ভাল কাজ করে জনগণ ও বড় দলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। ভাল ও গ্রহনযোগ্য উন্নয়নমূখী নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য এটাও একটা বিবেচ্য বিষয়। নির্বাচন কমিশন অনিবন্ধিত দলগুলোকে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না, যা সংবিধানের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। ইতিমধ্যে নিবন্ধিত অনেক দলের নেতা মারা গেছেন, অনেকে অসুস্থ, অনেকে নিষ্ক্রীয়, অনেকে হতাশ হয়ে রাজনীতি ছাড়ার উপক্রম। এভাবে সক্রিয় নিবন্ধিত দলের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় নতুন দল তৈরী হওয়া জরুরী। কেননা গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য বহুদলীয় ব্যবস্থায়। তবে দল নিবন্ধন আইনের কঠোরতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই আইনের সংশোধন করে দল সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
মোঃ ইয়ারুল ইসলাম